নিজেকে নিজে কষ্ট দেয়া, শরীরের কোন অংশ কাটা, পোড়ানো, অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়া বা অন্য কোনোভাবে নিজেকে আঘাত করা — এগুলোকে সাধারণভাবে আমরা “self-harm” বা “স্ব-আঘাত” বলি। কেউ যখন অনুভব করে তাকে কেউ শুনছে না, পর্যাপ্ত গুরুত্ব ও মনোযোগ দিচ্ছে না। কিশোর-কিশোরী বা স্ত্রী/মহিলা যখন নিজেকে ক্ষতি (Self Harm) করে “দেখাও” বা “দৃষ্টি আকর্ষণ” করার চেষ্টা করে, এর পিছনে লুকিয়ে তাদের অব্যক্ত যন্ত্রণা অথবা কোন চাওয়া। এই ব্লগে আমরা কিছু গল্পের আলোকে বোঝার চেষ্টা করব — কেন এমন হয়, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটার ব্যাখ্যা কী, ইসলামে এ বিষয়ে কী লেখা আছে, এবং কীভাবে পরিবার বা সমাজ সমর্থন দিতে পারে।
যেমন, গত মাসে ঢাকার একটি স্কুলে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি পুরো শিক্ষক সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ক্লাস নাইনের একটি মেয়ে নিজের হাতে কাটার দাগ নিয়ে স্কুলে এসেছিল। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, “আম্মু আমার কথা শোনে না। এখন হয়তো শুনবে।” স্কুলে বন্ধুরা হাতের ব্যান্ডেজ দেখে জিজ্ঞেস করলে রিতা সত্যি বলল। বন্ধুরা চিন্তিত হয়ে পড়ল, শিক্ষকরা খোঁজখবর নিতে লাগল। হঠাৎ রিতা দেখল সবাই তাকে নিয়ে ভাবছে। এই মনোযোগ তার ভালো লাগল।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশ্বব্যাপী গবেষণা বলছে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মক্ষতি (Self-harm) এর হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা ৩-৪ গুণ বেশি।
কিন্তু কেন একটি কিশোরী নিজেকে ক্ষতি করে? কী সেই মানসিক অবস্থা যা তাকে এমন পথ বেছে নিতে বাধ্য করে? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – আমরা কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারি?
আত্মক্ষতি (Self Harm) কী এবং কেন?
সংজ্ঞা
আত্মক্ষতি (Self-harm) বলতে বোঝায় নিজেকে ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিকভাবে আঘাত করা—কখনও কখনও আত্মহত্যার উদ্দেশ্য ছাড়াই (nonsuicidal self-injury, NSSI), এবং কখনোবা আত্মহত্যার ঝুঁকির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে NSSI-এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য — একাধিক সমীক্ষায় দেখা যায় কিশোরদের মোটামুটি ১৫–২০% পর্যায়ে NSSI রিপোর্ট করে।
পরিসংখ্যান
- বিশ্বব্যাপী ১৫-২৯ বছর বয়সী মেয়েদের ১৮% কমপক্ষে একবার আত্মক্ষতি করেছে
- বাংলাদেশে এই হার আনুমানিক ১২-১৫%
- ৮৫% ক্ষেত্রে প্রথম আত্মক্ষতি ঘটে ১২-১৬ বছর বয়সে
তিনটি গল্পঃ
গল্প ১: সাবিনার নীরব সংগ্রাম
তিন বছরের বিবাহিত জীবনে সাবিনা বুঝে গেছে তার মতামতের কোনো মূল্য নেই। শাশুড়ি সব সিদ্ধান্ত নেন, স্বামী রফিক অফিসের পর শুধু টিভি দেখেন। সাবিনার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা যেন কারও কাছে গুরুত্বহীন।
একদিন বিশেষ অবহেলার পর সাবিনা রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলে। পরদিন ব্যান্ডেজ দেখে স্বামী চিন্তিত হয়ে পড়ে, হঠাৎ তার কথা শুনতে শুরু করে।
সাবিনা বুঝল – ব্যথা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায়।
গল্প ২: জাহিদের মোটরসাইকেলের স্বপ্ন
১৫ বছর বয়সী জাহিদের একটাই চাওয়া – মোটরসাইকেল। বন্ধুদের সবার আছে, শুধু তার নেই। মধ্যবিত্ত বাবা-মা বারবার না করলে জাহিদ মনে করে তাকে কেউ ভালোবাসে না।
একদিন তুমুল ঝগড়ার পর রাগে-দুঃখে সে কম্পাস দিয়ে হাতে আঁচড় দেয়। পরদিন বাবা-মা দেখে ভয় পেয়ে যান, তার কথা শুনতে শুরু করেন।
জাহিদ শিখল – নিজেকে কষ্ট দিলে চাহিদা পূরণ হয়।
গল্প ৩: তানিয়ার অদৃশ্য চাপ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের “পারফেক্ট” জীবন দেখে নিজেকে ব্যর্থ মনে করে। পরীক্ষায় খারাপ করার পর একরাতে প্রথম নিজেকে ক্ষতি করে।
বন্ধুদের কাছে বলার পর তাদের চিন্তা আর সহানুভূতি তার মানসিক যন্ত্রণা কিছুটা কমায়।
তানিয়া অনুভব করল – ব্যথার বিনিময়ে সহানুভূতি পাওয়া যায়।
কেন এমন হয়? মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ
১. ভালোবাসার ভুল খোঁজ (Attention-Seeking)
যখন কেউ মনে করে তার কথা কেউ শুনছে না, তখন আত্মক্ষতি একটি নীরব চিৎকার হয়ে ওঠে।
২. আবেগের ঝড় সামলাতে না পারা (Emotional Dysregulation)
তীব্র রাগ, দুঃখ, হতাশার সময় যুক্তিবোধ কাজ করে না। আত্মক্ষতি তখন আবেগের একটি ভুল প্রকাশ।
৩. নিয়ন্ত্রণের মিথ্যা অনুভূতি
জীবনের অন্য ক্ষেত্রে যখন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখন আত্মক্ষতি একধরনের “ক্ষমতা” দেয়।
৪. ভুল শিক্ষা (Social Learning)
সোশ্যাল মিডিয়া বা পরিচিতদের দেখে আত্মক্ষতিকে “সমাধান” মনে করা।
৫. পুরস্কারের চক্র (Reinforcement)
আত্মক্ষতির পর যদি মনোযোগ বা যত্ন পাওয়া যায়, তাহলে এই আচরণ আরও শক্তিশালী হয়।
ইসলামী মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে
১. আত্মিক শূন্যতা (Spiritual Emptiness)
আল্লাহর সাথে সম্পর্কের অভাবে মানুষ আত্মিক শূন্যতায় ভোগে। এই শূন্যতা পূরণের জন্য ভুল পথ অবলম্বন করে।
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“যে আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য সংকুচিত জীবনযাত্রা নির্ধারণ করি।” (সূরা ত্বহা: ১২৪)
২. নফসের দুর্বলতা
ইসলামী দৃষ্টিকোণে, আত্মক্ষতি হলো নফসে আম্মারা (কুপ্রবৃত্তিপ্রবণ আত্মা) এর প্রভাব। সঠিক তাযকিয়া (আত্মশুদ্ধি) এর অভাবে নফস ভুল পথে পরিচালিত হয়।
৩. সবরের অভাব
ধৈর্যের অভাবে মানুষ কষ্টের সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। ইসলাম শিক্ষা দেয়:
“আর যারা ধৈর্য ধারণ করে, তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে বিনা হিসাবে।” (সূরা যুমার: ১০)
৪. তাওয়াক্কুলের অভাব
আল্লাহর উপর ভরসার অভাব এবং সমস্যার সমাধান নিজেই করতে হবে এই ভাবনা থেকে ভুল পথ গ্রহণ।
৫. দুনিয়ার মোহ
অতিরিক্ত বস্তুগত চাহিদা এবং দুনিয়ার প্রতি আসক্তি আত্মিক অশান্তি সৃষ্টি করে।
ইসলাম ও মনোবিজ্ঞানের আলোকে সমাধান
১. আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি
নিয়মিত সালাত: সালাত মানসিক প্রশান্তি আনে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত একটি কাঠামোবদ্ধ জীবনযাত্রা তৈরি করে।
কুরআন তিলাওয়াত: কুরআন তিলাওয়াত মানসিক চাপ কমায়। আল্লাহ বলেন:
“যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর যিকর দ্বারা তাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর যিকর দ্বারাই অন্তর প্রশান্ত হয়।” (সূরা রাদ: ২৮)
দোয়া ও যিকির: নিয়মিত দোয়া-যিকির আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং নেতিবাচক চিন্তা দূর করে।
২. পারিবারিক সম্পর্ক সুধার
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ইসলামী নির্দেশনা:
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম।” (হাদিস)
সন্তানের সাথে সুসম্পর্ক: ইসলামে সন্তানের মতামত শোনা এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহারের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
৩. সংযমের শিক্ষা
কুরআনের নির্দেশনা:
“আর যারা যখন ব্যয় করে তখন অপচয় করে না, কৃপণতাও করে না, বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান: ৬৭)
রাসূল (সা.) এর শিক্ষা: দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি না রেখে পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার শিক্ষা।
আধুনিক মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা:
১. Cognitive Behavioral Therapy (CBT)
চিন্তার ধরণ পরিবর্তন:
- নেতিবাচক চিন্তাভাবনা চিহ্নিত করা
- বাস্তবসম্মত চিন্তায় রূপান্তর
- সমস্যা সমাধানের বিকল্প উপায় খোঁজা
আচরণ পরিবর্তন: আত্মক্ষতির বদলে স্বাস্থ্যকর মোকাবেলার পদ্ধতি শেখানো:
- ব্যায়াম করা
- জার্নাল লেখা
- শিল্প ও সৃজনশীল কাজ
- বন্ধুদের সাথে কথা বলা
২. Dialectical Behavior Therapy (DBT)
আবেগ নিয়ন্ত্রণ:
- তীব্র আবেগের সময় নিজেকে শান্ত করার কৌশল
- শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম
- Grounding techniques
Mindfulness অনুশীলন: বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ দিয়ে থাকার অনুশীলন।
৩. Family Therapy
যোগাযোগ উন্নতি:
- খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি
- সবার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া
- সমস্যা সমাধানে সবার অংশগ্রহণ
সহায়ক পরিবেশ: এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে সবাই নিজের সমস্যার কথা খোলামেলা বলতে পারে।
আপনি কীভাবে সাহায়তা করতে পারেন?
যদি আপনার পরিচিত কেউ আত্মক্ষতি করে:
১. বিচার না করে শুনুন:
- “তুমি কেন এমন করলে?” এর বদলে বলুন “তুমি নিশ্চয়ই অনেক কষ্টে আছো”
- তাদের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন
২. তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন:
- গুরুতর ক্ষত থাকলে চিকিৎসক দেখান
- আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকলে একা রাখবেন না
৩. পেশাদার সাহায্য নিন:
- মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান
- কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করুন
৪. ধৈর্য ধরুন:
- একদিনে পরিবর্তন আশা করবেন না
- ছোট উন্নতিকে উৎসাহিত করুন
পরিবার হিসেবে করণীয়:
- খোলামেলা কথা বলার পরিবেশ তৈরি করুন
- সবার মতামতকে গুরুত্ব দিন
- শর্তহীন ভালোবাসা প্রকাশ করুন
- একসাথে ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ করুন
উপসংহার — কীভাবে আপনার আশেপাশের কেউ সাহায্য পেতে পারে
আত্মক্ষতি কোনো সমাধান নয়, বরং সাহায্যের জন্য একটি নীরব আর্তনাদ। যখন কেউ নিজেকে ক্ষতি করে, তখন তারা আসলে বলতে চায় – “আমি কষ্টে আছি, আমাকে সাহায্য করো।”
মনে রাখবেন: প্রতিটি ক্ষত নিরাময় হতে পারে, প্রতিটি ব্যথার অবসান সম্ভব। ভালোবাসা, ধৈর্য এবং সঠিক সহায়তার মাধ্যমে যেকোনো অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফেরা যায়। আজই একটি হাত বাড়িয়ে দিন। আপনার সহানুভূতি হয়তো কারও জীবন বাঁচাতে পারে।
আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ ঝুঁকিতে থাকলে—দয়া করে অপেক্ষা করবেন না। স্থানীয় জরুরি সেবা, হাসপাতাল বা মানসিক সুস্থতা সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করুন। যদি চান, Sukoonlife-এ আমরা সহানুভূতিশীল কাউন্সেলিং দিয়ে পাশে আছি—Sukoonlife.org থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারেন।
