দুটি পরিচিত গল্প
রিয়া’র গল্প
২৩ বছর বয়সী রিয়া একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। অফিসের মিটিংয়ে যখন তার কথার চেয়ে সহকর্মীদের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন সে গভীরভাবে আহত হয়। বাড়িতে ফিরে সে তার স্বামীর কাছে ক্রমাগত প্রশংসা ও মনোযোগ দাবি করে। যদি স্বামী ফোনে থাকে বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে, রিয়া অভিমান করে নীরব হয়ে যায়।
“ছোটবেলায় আমি ছিলাম মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। তারা আমার প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। আমি যা চাইতাম, তা-ই পেতাম। এখন মনে হয় সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছে,” বলে রিয়া।
রোমানে’র গল্প
২৮ বছর বয়সী রোমান একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করে। সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত তার সাফল্যের কথা শেয়ার করে। বন্ধুদের আড্ডায় সে সবসময় কথার কেন্দ্রবিন্দু হতে চায়। যদি কেউ তার কথায় মনোযোগ না দেয় বা অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা শুরু করে, রোমান বিরক্ত হয়ে উঠে।
“আমার বাবা-মা আমাকে ‘সোনার ছেলে’ বলে ডাকতেন। আমি যেখানেই যেতাম, সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করত। এখন মনে হয় আমার মূল্য কমে গেছে,” স্বীকার করে আরিফ।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটির লক্ষণ
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে এই ধরনের আচরণকে নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ট্রেইট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
১. অতিরিক্ত মনোযোগ আকাঙ্ক্ষা: ব্যক্তি সর্বদা অন্যদের প্রশংসা ও স্বীকৃতি পেতে চায়।
২. আত্ম-গুরুত্বের অতিরঞ্জিত অনুভূতি: নিজেকে অন্যদের থেকে বিশেষ ও উন্নত মনে করা।
৩. সহানুভূতির অভাব: অন্যদের অনুভূতি ও প্রয়োজনের প্রতি উদাসীনতা।
৪. হিংসা ও ঈর্ষা: অন্যরা মনোযোগ পেলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।
শৈশবের অভিজ্ঞতার প্রভাব
মনোবিজ্ঞানী অটো কার্নবার্গ এবং হেইঞ্জ কোহুট এর গবেষণা অনুযায়ী, শৈশবের নিম্নলিখিত অভিজ্ঞতাগুলি এই ধরনের ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে:
অতিরিক্ত প্রশংসা: শিশুকে যখন অতিরিক্ত প্রশংসা করা হয় এবং তার প্রতিটি কাজকে “বিশেষ” বলে আখ্যায়িত করা হয়।
শর্তসাপেক্ষ ভালোবাসা: শুধুমাত্র ভালো পারফরমেন্স করলেই ভালোবাসা পাওয়ার অভিজ্ঞতা।
আবেগিক অবহেলা: শিশুর প্রকৃত আবেগিক চাহিদাগুলি পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও বাহ্যিক প্রশংসা পাওয়া।
অ্যাটাচমেন্ট থিওরির আলোকে
জন বোলবি’র অ্যাটাচমেন্ট থিওরি অনুযায়ী, শৈশবে যেসব শিশু “অ্যাংজিয়াস অ্যাটাচমেন্ট” অভিজ্ঞতা করে, তারা পরবর্তীতে মনোযোগ পাওয়ার জন্য অস্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। এই শিশুরা নিম্নলিখিত প্যাটার্ন দেখায়:
- ক্রমাগত যত্নদাতার (caregiver) মনোযোগ দাবি করা
- পরিত্যক্ত হওয়ার তীব্র ভয়
- অন্যদের আবেগিক প্রাপ্যতার উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা
ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিশ্লেষণ
তাওহীদের নীতি ও আত্মকেন্দ্রিকতা
ইসলামের মূলনীতি তাওহীদ অনুযায়ী, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সমস্ত প্রশংসা ও মহিমার যোগ্য। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের রব্ব।” (সূরা ফাতিহা: ২)
যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বানাতে চায়, তখন সে অজান্তে শিরকের একটি সূক্ষ্ম রূপে জড়িয়ে পড়ে। কারণ সে নিজেকে এমন এক অবস্থানে রাখতে চায় যা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত।
গর্ব ও অহংকারের পরিণতি
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (সহিহ মুসলিম)
ক্রমাগত মনোযোগ চাওয়ার পেছনে যে আত্মম্ভরিতা ও অহংকার কাজ করে, তা ইসলামে গুরুতর পাপ হিসেবে বিবেচিত।
ইসলামি সাইকোলজিতে আত্মপরিচয়ের ধারণা
ইসলামি সাইকোলজি অনুযায়ী, মানুষের পরিচয় তিনটি স্তরে বিভক্ত:
১. নাফ্স আম্মারাহ (কু-প্রবৃত্তি): এই স্তরে মানুষ শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছা ও চাহিদার দ্বারা পরিচালিত হয়। মনোযোগ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এই স্তরের একটি প্রকাশ।
২. নাফ্স লাওয়ামাহ (আত্মসচেতন প্রবৃত্তি): এই স্তরে ব্যক্তি তার ভুলগুলি চিহ্নিত করতে পারে এবং আত্ম-সংশোধনের চেষ্টা করে।
৩. নাফ্স মুতমায়িন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা): এই স্তরে পৌঁছে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিতেই পূর্ণ তৃপ্তি খুঁজে পায়।
হাদিসের আলোকে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে মানুষের উপকার করে।” (তিরমিযী)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, ব্যক্তির মূল্য নিহিত রয়েছে অন্যদের সেবায়, নিজের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণে নয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
ব্যক্তিগত সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব
সম্পর্কের ক্ষতি: ক্রমাগত মনোযোগ দাবি করার ফলে পারিবারিক ও বন্ধুত্বের সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি হয়।
আস্থার অভাব: অন্যরা এই ধরনের ব্যক্তির সাথে সহজ ও স্বাভাবিক আচরণ করতে দ্বিধা বোধ করে।
একাকিত্ব: পরিণতিতে ব্যক্তি আরও গভীর একাকিত্বে ভোগে এবং এই দুষ্টচক্র আরও তীব্র হয়।
উদ্বেগ ও বিষণ্নতা
পারফরমেন্স অ্যাংজাইটি: সবসময় “পারফেক্ট” থাকার চাপে ব্যক্তি তীব্র মানসিক চাপে ভোগে।
রিজেকশন সেনসিটিভিটি: সামান্য অবহেলাও গভীর আঘাত হিসেবে অনুভূত হয়।
আত্মসম্মানের অস্থিরতা: বাহ্যিক প্রশংসার উপর নির্ভরশীলতার কারণে আত্মসম্মান ক্রমাগত ওঠানামা করে।
সমাধানের পথ: মনোবিজ্ঞান ও ইসলামি পরামর্শ
জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি (CBT)
চিন্তার পুনর্গঠন: “আমাকে সবার মনোযোগ দিতেই হবে” – এই ধরনের চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং আরও বাস্তববাদী চিন্তার অভ্যাস গড়ে তোলা।
গ্র্যাটিটিউড জার্নালিং: প্রতিদিন ৩টি করে ইতিবাচক বিষয় লেখার অভ্যাস যা নিজের উপর নির্ভরতা কমায়।
মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন: বর্তমান মুহূর্তে থাকার অভ্যাস যা অহং-চালিত চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়।
ইসলামি সমাধান
১. নিয়মিত তওবা ও ইস্তিগফার: প্রতিদিন নিজের অহংকার ও আত্মকেন্দ্রিকতার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
২. যিকর ও তাসবিহ: “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম” – এই যিকরের মাধ্যমে আল্লাহর মহত্ত্ব স্মরণ করা এবং নিজের ক্ষুদ্রতা উপলব্ধি করা।
৩. সাদাকা ও সেবামূলক কাজ: অন্যদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা যাতে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বের হওয়া যায়।
৪. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত: বিশেষত সূরা কাহাফ (গুহা) এর শেষ আয়াতগুলো পড়া:
“বলুন, ‘আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমার কাছে ওহী আসে যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ।'” (১৮:১১০)
ব্যবহারিক কৌশল
১. ৩০-দিনের চ্যালেঞ্জ: প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করা অন্যদের জন্য, নিজের কৃতিত্ব প্রকাশ না করে।
২. শোনার অভ্যাস গড়া: কথোপকথনে নিজে কথা বলার চেয়ে অন্যদের কথা শোনার অভ্যাস করা।
৩. প্রশংসার নতুন সংজ্ঞা: “প্রকৃত প্রশংসা আল্লাহর কাছ থেকে আসে” – এই বিশ্বাসকে মনে গেঁথে নেওয়া।
৪. সেলফ-কমপ্যাশন অনুশীলন: নিজের ত্রুটিগুলো মেনে নেওয়া এবং নিজের সাথে দয়াশীল আচরণ করা।
দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের জন্য কর্মপরিকল্পনা
প্রথম মাস: সচেতনতা সৃষ্টি
- প্রতিদিন ৫ মিনিট আত্মপর্যবেক্ষণ
- যখনই মনোযোগ চাওয়ার ইচ্ছা হয়, সেটি জার্নালে লিখে রাখা
- প্রতি নামাজের পর ৩টি তাসবিহ পড়া
দ্বিতীয় মাস: আচরণ পরিবর্তন
- সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সাফল্যের পোস্ট ৫০% কমানো
- সপ্তাহে ১টি সেবামূলক কাজ করা
- অন্যদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার অভ্যাস করা
তৃতীয় মাস: নতুন পরিচয় গঠন
- “আমি আল্লাহর বান্দা” – এই পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা
- অন্যদের প্রশংসা করার অভ্যাস গড়া
- নিজের ভুলগুলো স্বীকার করার সাহস অর্জন
উপসংহার
মনোযোগ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা একটি গভীর মানসিক সমস্যা যার শিকড় রয়েছে শৈশবের অভিজ্ঞতায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও ইসলামি সাইকোলজি উভয়ই এই সমস্যার কার্যকর সমাধান প্রদান করে। মূল লক্ষ্য হল আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তোলা।
মনে রাখবেন, প্রকৃত মুক্তি আসে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে, মানুষের প্রশংসা দিয়ে নয়। রিয়া ও আরিফের মতো অসংখ্য মানুষ এই পথে চলে আত্মিক প্রশান্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছেন। আপনিও পারবেন।
সুকুন লাইফের পক্ষ থেকে আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ কামনা করছি।
আরও জানতে আমাদের সাথে থাকুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন।
