ফ্রয়েডের মৃত্যুচিন্তা বনাম ইসলামী মনোবিজ্ঞান: একটি গভীর পর্যালোচনা

আমি দীর্ঘদিন ধরে ফিলোসফি ও মনোবিজ্ঞানের একজন আগ্রহী ছাত্র। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের লেখা ও তত্ত্ব বহু বছর ধরে পড়েছি। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে একটি প্রবন্ধ পড়ে মনে হলো, ফ্রয়েডের তত্ত্বগুলোর একটি শ্রদ্ধাশীল কিন্তু সমালোচনামূলক পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। কারণ তাঁর ভাবনা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সূচনা করলেও, সেখানে অনেক বড় শূন্যতা আছে, যা কেবল ইসলাম পূরণ করতে পারে।

মৃত্যুর মুখে ফ্রয়েডের আত্মসমর্পণ: বনাম ইসলামের ধৈর্য ও পুরস্কার

১৯৩৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত ফ্রয়েড তাঁর চিকিৎসক বন্ধুর কাছে মৃত্যু ত্বরান্বিত করার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “অহেতুক আর বেশি কষ্ট দিয়ো না। এখন আর যন্ত্রণা ছাড়া কিছু নেই, অর্থহীন লাগে।”

এখানেই আমাদের প্রথম প্রশ্ন উঠে আসে। ইসলামী দর্শনে মৃত্যু হলো আল্লাহর নির্ধারিত সময়ে ঘটা একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কুরআনে বলা হয়েছে:

“আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ মৃত্যুবরণ করবে না, এটা নির্ধারিত সময়ের লিখিত বিধান।” (সূরা আলে ইমরান: ১৪৫)

ইসলামী মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, কষ্টের মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা একটি আধ্যাত্মিক পরীক্ষা। এই ধৈর্যের বিনিময়ে মু’মিনরা আল্লাহর কাছ থেকে অফুরন্ত সওয়াব পায়। অথচ ফ্রয়েড এই পরীক্ষা থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ইসলামের দৃষ্টিতে, মৃত্যু কারও হাতে নয়; জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহর হাতে। আত্মহত্যা বা মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করা ইসলামে হারাম।
বরং রোগ, কষ্ট ও ধৈর্যের মধ্যে যে ঈমানদার অবিচল থাকে, আল্লাহ তাঁর জন্য অপার সওয়াব রাখেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “যে মুমিন কাঁটা বিঁধলেও ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করেন।”
ফ্রয়েডের শেষ যন্ত্রণা আসলে মানবিক দুর্বলতার প্রকাশ, যেখানে ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়—কষ্টও ইবাদতের অংশ, ধৈর্যও মুক্তির পথ।

জীবনের উদ্দেশ্য: মৃত্যু নয়, বরং আল্লাহর ইবাদত

ফ্রয়েড বলেছিলেন, “সারা জীবনের লক্ষ্য হলো মৃত্যু।” এই উক্তিটি তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক শূন্যতার পরিচয় বহন করে। তিনি মনে করতেন মানুষ মরে যেতে চায় বলেই মারা যায়। কিন্তু ইসলাম বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। মানুষের জীবনের লক্ষ্য মৃত্যু নয়; বরং আল্লাহর ইবাদত করা, জান্নাত অর্জন করা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া।

ইসলামী দর্শনে জীবনের মূল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

“আমি জিন ও মানুষকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত: ৫৬)

অর্থাৎ, জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হলো আল্লাহর ইবাদত করা, জান্নাত অর্জন করা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া। মৃত্যু কেবলমাত্র আখিরাতের জীবনে প্রবেশের একটি দরজা, জীবনের শেষ গন্তব্য নয়। সুতরাং জীবন শুধু জৈবিক অস্তিত্ব নয়—এটি আল্লাহর সাথে এক অঙ্গীকার, যা মৃত্যুতে শেষ হয় না।

যৌনতার ভূমিকা: ফ্রয়েডের ইরোস-থানাটোস বনাম সামাজিক সৎকর্ম

ফ্রয়েড তাঁর “বিয়ন্ড দ্য প্লেজার প্রিন্সিপাল” গ্রন্থে দাবি করেছেন যে, যৌন আকাঙ্ক্ষা বা ইরোসই মানুষের বেঁচে থাকার শক্তি। তিনি মনে করতেন যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে গেলে বেঁচে থাকার ইচ্ছাও কমে যায়। আর মৃত্যুবৃত্তি (থানাটোস) মানুষকে আত্মধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

এই তত্ত্বটি মানব প্রকৃতির একটি অংশকে সমগ্র জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ফেলে। বাস্তবতা হলো, অসংখ্য মানুষ যৌন আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে অথবা নিয়ন্ত্রণ করে পূর্ণাঙ্গ ও অর্থবহ জীবনযাপন করেছেন, সমাজের জন্য অমূল্য অবদান রেখেছেন।

ইতিহাসে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে মানুষ অন্যদের সেবায় নিজেদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন:

  • ইমাম নববী (রাহ.)—অবিবাহিত থেকেও ইসলামি জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার রেখে গেছেন।
  • ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জ্ঞান বিতরণ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন
  • অনেক স্বেচ্ছাসেবক ও সন্ন্যাসীসদৃশ মানুষ—অন্যকে সাহায্য করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
  • পৃথিবীব্যাপী নানা ধর্ম-বর্ণ ও মতের মানুষ, অসংখ্য শিক্ষক, চিকিৎসক, গবেষক এবং সমাজকর্মী রয়েছেন যারা ব্যক্তিগত ভোগের চেয়ে মানবকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

এগুলো প্রমাণ করে, মানুষ শুধু ‘ইরোস’ বা প্রবৃত্তির দাস নয়। সৎকর্ম, দানশীলতা, অন্যকে সাহায্য, জ্ঞানচর্চা—এসবও বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। ইসলাম এখানে নতুন দিগন্ত খোলে—“সর্বোত্তম মানুষ সে-ই, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে উপকারী।” ইসলামে বিবাহকে সুন্নত বলা হয়েছে, কিন্তু একে জীবনের একমাত্র চালিকাশক্তি বলা হয়নি। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।

মৃত্যুপরবর্তী জীবন: ফ্রয়েডের অস্বীকার বনাম ইসলামী বিশ্বাস

ফ্রয়েড মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে কোনো বিশ্বাস রাখতেন না। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে, তিনি বলেছিলেন, “আমি এ বিষয়টা নিয়ে ভাবি না। জীবিত সবকিছুই ধ্বংস হয়। আমি কেন বেঁচে থাকব।”

এই উত্তর তাঁর আধ্যাত্মিক দৈন্যতার স্পষ্ট প্রমাণ। আখিরাতের জীবনে বিশ্বাস মানুষকে দুনিয়ার জীবনে অর্থ ও উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে। কুরআনে বলা হয়েছে:

“আর যে ব্যক্তি এই জীবনে অন্ধ, সে পরকালেও অন্ধ এবং অধিক পথভ্রষ্ট।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ৭২)

ইসলামী মনোবিজ্ঞানে আখিরাতের বিশ্বাস একটি শক্তিশালী মানসিক সহায়ক শক্তি। এটি মানুষকে কঠিন সময়ে ধৈর্য ধরতে, ভাল কাজে অনুপ্রাণিত হতে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। আমাদের আরো শেখায়—জীবন শেষ নয়, বরং আখিরাত আসল জীবন। জান্নাতের আনন্দ, আল্লাহর সান্নিধ্য, চিরস্থায়ী মুক্তি—এসবই মুমিনের আকাঙ্ক্ষা। মৃত্যুকে ভয় নয়, বরং এক সেতু হিসেবে দেখা হয়, যা মানুষকে দুনিয়ার কষ্ট থেকে মুক্ত করে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।

ফ্রয়েডের মানসিক অস্বাভাবিকতা: ইসলামী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা

ফ্রয়েড তাঁর স্ত্রী মার্থার অসুস্থতায় একসময় তাকে হত্যা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন—যা তাঁর ‘ডেথ ড্রাইভ’-এর উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়।

ফ্রয়েডের আনকনশাস ডেথ উইশেস চ্যাপ্টারে আছে, ফ্রয়েডের অনুমোদিত জীবনীকার জোন্স জানিয়েছেন, ফ্রয়েড তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মার্থার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন একসময়। এই উদ্বেগ থেকে মার্থাকে হত্যাও করতে চেয়েছিলেন। এটাকে মৃত্যুর অচেতন ইচ্ছার প্রকাশ বলে ধারণা করা হয়। মার্থার কাছে লেখা তাঁর চিঠিগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ফ্রয়েডের আবেগ স্বাভাবিক প্রেমময় ধরনের ছিল না।

এটি আসলে এক ধরণের মানসিক ব্যাধি। আর এখানেই ফ্রয়েড ও আধুনিক সাইকোলজির সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ে। মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতা, অস্থির আবেগ, মৃত্যুভয়—এসব কেবল থেরাপি দিয়ে পূর্ণ হয় না। ইসলাম এখানে হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভরসা, তাকওয়া, দোয়া, ইবাদত ও আখিরাতের বিশ্বাসের মাধ্যমে এক গভীর স্থিরতা এনে দেয়। এই বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয় যে ফ্রয়েড নিজেই গভীর মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন।

ইসলামী মনোবিজ্ঞান: সার্বিক সমাধানের পথ

ইসলামী মনোবিজ্ঞান মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি সমগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে:

১. আধ্যাত্মিক সংযোগ (তাওহীদ)

আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মানুষকে জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য প্রদান করে। এটি মানসিক শূন্যতা পূরণ করে যা ফ্রয়েডের মতো চিন্তাবিদদের মধ্যে দেখা যায়।

২. নৈতিক কাঠামো (শরীয়াহ)

ইসলামের নৈতিক নির্দেশনা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং মানসিক দ্বন্দ্ব কমায়।

৩. সামাজিক সহায়তা (উম্মাহ)

ইসলামী সমাজের সংহতি ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৪. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (তাওয়াক্কুল)

আল্লাহর ওপর ভরসা করা মানুষকে জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে মানসিক শক্তি প্রদান করে।

সবশেষে: পূর্ণাঙ্গতার দিকে এগিয়ে চলা

ফ্রয়েড আধুনিক মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ—কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা অসম্পূর্ণ। কিন্তু তাঁর তত্ত্বের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক শূন্যতা ও একদেশদর্শিতা রয়েছে, সেই ফাঁকটি পূরণ করতে পারে একমাত্র ইসলামী জীবনদর্শন। তিনি মানুষের জৈবিক ও প্রবৃত্তিগত দিককে বড় করে দেখালেও, আত্মার আকাঙ্ক্ষা, আখিরাতের বিশ্বাস, ইবাদতের শক্তি—এসব পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন। আজকের দিনে আমরা যদি কেবল ফ্রয়েডের দৃষ্টিতে মানুষকে দেখি, তবে মানবজীবন হয়ে যাবে অন্ধকারময়, প্রবৃত্তিনির্ভর এবং হতাশাগ্রস্ত।

আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সাথে ইসলামী শিক্ষার সমন্বয়ে আমরা এমন একটি পদ্ধতি গড়ে তুলতে পারি যা মানুষের দেহ, মন ও আত্মার সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করবে। যেখানে প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়, আবেগ সঠিক পথে প্রবাহিত হয়, এবং জীবন-মৃত্যু সবকিছু অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে।

Sukoonlife.org-এ আমাদের লক্ষ্যই হলো এই ভারসাম্য তৈরি করা—আধুনিক মনোবিজ্ঞানের গবেষণা ও ইসলামের প্রজ্ঞা একত্রিত করে মানুষের মন, আত্মা ও জীবনে প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনা।


 

লেখক: খন্দকার আরিফুল হক
Sukoonlife: Islamic Psychology & Modern Mental Health Solutions

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *